বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও গ্রামীণ স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ইউনিয়ন পরিষদ সর্বনিম্ন স্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। তৃণমূল পর্যায়ের হলেও গ্রামীণ জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ নিরলস প্রচেষ্টায় লিপ্ত। স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এটি একটি স্বীকৃত মাধ্যম। সুষ্ঠু স্থানীয় প্রশাসন ব্যতীত যেমন সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থা সম্ভব নয় তেমনি সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থা ছাড়া শক্তিশালী স্থানীয় প্রশাসন আশা করা যায় না। অতএব ইউনিয়ন পরষিদসমূহের প্রশাসন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর তাই চৌকিদারি কর আদায়ের মাধ্যমে চৌকিদারদের বেতন প্রদানের জন্য ১৮৭০ সালের গ্রাম চৌকিদারি আইন পাস হয়। এর ফলে প্রথমবারের মতো পল্লী অঞ্চলে আইনগত ভিত্তির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়।
১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন বাতিল বা সংশোধন করে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২২-এর মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ নামকরণ করে এবং ১৯৮৩ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ প্রবর্তনের ফলে ইউনিয়ন পরিষদের গঠন ও এর নিজস্ব আয়ের উৎসের পরিবর্তন ঘটেছে। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর ৪৩ নং ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের জন্য ‘ইউনিয়ন তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠিত হবে এবং উক্ত ধারার উপধারা-১-এর অধীনে বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ এই তহবিলে জমা হবে মর্মে আইন পাস হয়।
ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের উৎস মূলত ৩টি। যেমনÑ রাজস্ব আয়, সরকারী অনুদান এবং অন্যান্য উৎস। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ ও স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) (সংশোধনী) আইন ১৯৯৩ এবং সরকারের নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদকে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ৬টি বিষয়ের ওপর কর, রেট, ফি ইত্যাদি আরোপ ও আদায়ের ক্ষমতা দেয়া হয়। এগুলো হলো-
ক) ঘরবাড়ির বার্ষিক মূল্যের উপর কর অথবা ইউনিয়ন রেট নির্ধারিত পদ্ধতিতে আদায়যোগ্য। যাকে আমরা হোল্ডিং ট্যাক্স বলে থাকি। এটিই মূলত ইউনিয়ন পরিষদের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস।
খ) পেশা, ব্যবসা এবং বৃত্তি (কলিং) এর উপর কর;
গ) সিনেমা, নাটক, থিয়েটার প্রদর্শনী এবং অন্যান্য আপ্যায়ন এমন ধরনের প্রমোদ কর;
ঘ) পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত লাইসেন্স এবং পারমিটের জন্য ফি;
ঙ) ইউনিয়নের সীমানার মধ্যে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হাট-বাজার এবং ফেরি হতে ফি (লিজ মানি);
কর আরোপ ও আদায়
দায়িত্ব অনুযায়ী আয়ের পথ সুগম করতে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর ৫৩ ধারা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের অনুমোদন লাভের পর ইউনিয়ন পরিষদকে কর আরোপ ও আদায়ের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আবার সরকার আদর্শ কর তফসিল প্রণয়ন করতে পারে। কর তফসিল প্রণীত হলে ইউনিয়ন পরিষদ আদর্শ কর তফসিল অনুযায়ী কর, রেট, ফি ধার্য করবে। ঘর-বাড়ির বার্ষিক মূল্যের ওপর কর অথবা রেট ধার্য করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদকে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য কর মূল্যায়ন তালিকা তৈরি করতে হবে। জেলা প্রশাসকের অনুমোদনক্রমে ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত এসেসর মূল্যায়ন তালিকা তৈরি করবেন। মূল্যায়ন সম্পর্কে কারও কোন আপত্তি থাকলে বিধি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। অতঃপর ইউনিয়ন পরিষদের বিশেষ সভায় মূল্যায়ন তালিকা গৃহীত হবার পর জেলা প্রশাসকের অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হবে। ঘর-বাড়ির বার্ষিক মূল্যের সর্বোচ্চ শতকরা ৭ টাকা হারে ঘরবাড়ির কর ধার্য করতে হবে।
কর আদায় পদ্ধতি
১) ইউনিয়ন পরিষদ কর, রেট, ফি ইত্যাদি আদায়ের ব্যবস্থা করবে।
২) ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে কে বা কারা কর, রেট, ফি বাবদ অর্থ কোন স্থানে বা সময়ে গ্রহণ করবে বা আদায় করবে তা নোটিশের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ জনগণকে অবহিত করবে। তবে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের নোটিশ বোর্ডে অথবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নোটিশ টাঙ্গানো যাবে।
৩) করদাতা ইউনিয়ন পরিষদ অফিস বা অফিসের বাইরে ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নিকট অথবা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত ব্যাংকে কর প্রদান করতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদ কর আদায়ের রশিদ প্রদান করবে (ইউপি ফরম নং-১০)। রশিদে চেয়ারম্যান ও আদায়কারীর স্বাক্ষরসহ কত টাকা পরিশোধ করা হলো এবং কত টাকা পাওনা থাকল তা উল্লেখ থাকতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত ব্যাংকে কর পরিশোধ করলে, ব্যাংক রশিদ প্রদান করবে।
৪) বিধি ১০ অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ কর, রেট, ফি ইত্যাদি আদায়ের জন্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাহিদা অনুযায়ী বিল প্রেরণ করবে। কোন তারিখের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে তা উক্ত বিলে উল্লেখ থাকবে। কোন করদাতা নির্ধারিত তারিখের মধ্যে দাবিকৃত সমুদয় অর্থ পরিশোধ করলে তাকে ৫% হারে রেয়াত দেয়া যাবে।
৫) কর প্রদানকারীর দুর্দশা বা কোন অসুবিধার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ সর্বাধিক ৬ মাস পর্যন্ত কর, রেট, ফি আদায় স্থগিত রাখতে পারে।
৬) ইউনিয়ন পরিষদের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, কোন কর, রেট, ফি, টোল আরোপ বা আদায়ের ক্ষেত্রে কোন কর প্রদানকারী দুর্দশাগ্রস্ত হবে তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ ধার্যকৃত অর্থের শতকরা ১৫ ভাগ হ্রাস করতে পারে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ যদি মনে করে শতকরা ১৫ ভাগের অধিক হ্রাস করা উচিত তাহলে করদাতা কর্তৃক ১৫% হ্রাসকৃত অর্থ পরিশোধের পর বিষয়টি বিবেচনার জন্য জেলা প্রশাসকের নিকট প্রেরণ করবে। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
৭) বিধি ১২ অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত তারিখের মধ্যে কোন ব্যক্তি কর পরিশোধে ব্যর্থ হলে বকেয়া করের তালিকা ইউনিয়ন পরিষদ প্রণয়ন করে নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দেবে। নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গানোর পর থেকে ১৫ দিন অতিক্রম করলে ইউনিয়ন পরিষদ সরকারী দাবি বা ভূমি রাজস্ব হিসেবে অথবা ক্রোক নোটিশ এবং অস্থাবর মালামাল বিক্রির মাধ্যমে বকেয়া করের অর্থ আদায় করতে পারবে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ক্রোক পরোয়ানা জারি করবেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা চেয়ারম্যান কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদের বেতনভুক্ত কর্মচারী ক্রোক পরোয়ানা জারির বাস্তবায়ন করবেন।
৮) বিধি ১৮ অনুযায়ী পরিষদ কর্তৃক আদায় করা সম্ভব নয় এমন কর এর অর্থ আদায় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ বিরত থাকতে পারবে।
ইউনিয়ন পরিষদের ১০টি বাধ্যতামূলক এবং ৩৮টি ঐচ্ছিক দায়িত্ব ছাড়াও বিভিন্ন দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হয়। কিন্তু এসব দায়িত্ব পালনের জন্য অনেক সময়ই অর্থের প্রয়োজন হয়। অপর্যাপ্ত আয়ের ফলে জনগণের অনেক প্রয়োজনীয় কাজ যথাযথভাবে করা সম্ভব হয় না। পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থের সংস্থান ইউনিয়ন পরিষদের থাকে না। এজন্য এর আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো অনস্বীকার্য।
যথাযথভাবে এসেসমেন্ট করে হোল্ডিং ট্যাক্স বা কর ধার্য করা এবং তা আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময় সাপেক্ষ একটি কাজ; কেননা, কর আদায় ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা, সরকারী সাহায্য ইত্যাদি আয়কে কিভাবে ব্যয় করা হচ্ছে, সংগ্রহকৃত সব তহবিলের প্রশাসন, বাজেট প্রণয়ন, হিসাবপত্র সংরক্ষণ, অডিট বা হিসাব নিরীক্ষা ইত্যাদি আর্থিক ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদ এ কাজটি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে সক্ষম নয়।
শক্তিশালী স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম আরও বেগবান করার জন্য এবং কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থায়ী কর আদায়কারী নিয়োগসহ ইউনিয়ন পরিষদের জনবল বাড়ানো প্রয়োজন। কর প্রদানে জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন সরকারী সেবা যেমনÑব্যাংক ঋণ, বিভিন্ন সরকারী লাইসেন্স, জমি কেনা-বেচা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের কর পরিশোধের রশিদ সংযুক্তকরণ বাধ্যতামূলক করা উচিত।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় সরকার হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী করতে হবে এবং এজন্য দরকার আর্থিক স্বনির্ভরতা। স্বাধীন ও স্বনির্ভর স্থানীয় সরকার কার্যকর হলেই উন্নয়ন হবে ত্বরান্বিত। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র তথা সরকারের উদারতা ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা ছেড়ে সহায়কের ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস